ইমাম হোসেন ফয়সাল:
কুমিল্লায় মামলা দায়েরের ২৪ ঘন্টার মধ্যে স্ত্রী হত্যাকারী পাষন্ড স্বামী মোঃ ইকবাল(৩৮)র্যাব-১১, সিপিসি-২ কর্তৃক গ্রেফতার।
গত ২৪ এপ্রিল ২০২২ইং তারিখে কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী থানার কালির বাজার ইউনিয়নের মস্তফাপুর (কাছার) এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে বিলের মাঝে গৃহবধু মোসাঃ ফারজানা বেগম(২৯), পিতা-মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন, সাং-আলেখারচর দক্ষিণপাড়া, থানা-কোতয়ালী, জেলা-কুমিল্লা এর হাত মুখ বাধা অবস্থায় রক্তাক্ত লাশ দেখে স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের সাহায্যে কুমিল্লা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে ময়না তদন্তের শেষে ভিকটিমের বাবা মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন২৪/০৪/২০২২ইং তারিখ বাদী হয়ে কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী মডেল থানায় ০৭জনকে এজাহারভুক্ত ও ২/৩ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করে মামলা দায়ের করেন, যার মামলা নং-৭৪/৩৯৬, তারিখ ২৪/০৪/২০২২ইং।
ঘটনাটি বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে কুমিল্লাসহ সারা দেশে ব্যপক চাঞ্চল্যর সৃষ্টি হয়। ঘটনাটি অত্যন্ত নির্মম ও হৃদয় বিদারক হওয়ায় র্যাব-১১, সিপিসি-২, কুমিল্লা এর গোয়েন্দা দল জড়িতদের গ্রেফতারের জন্য কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে গত ২৫ এপ্রিল ২০২২ইং তারিখ কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে উক্ত মামলার এজাহার নামীয় ২, ৩ এবং ৬নং আসামীদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
গ্রেফতারকৃত আসামীরা হলোঃ ২। মোঃ মোক্তার হোসেন(৪৫), পিতা-কাজী মোঃ আঃ হাকিম; ৩। কাজী মোঃ আঃ হাকিম, পিতা-মৃত আর্জন আলী এবং ৬। মোঃ আনোয়ার হোসেন(৫২), পিতা-মৃত মোখলেছুর রহমান, সর্বসাং-অলিপুর (উত্তর কাছার), থানা-কোতয়ালী মডেল, জেলা-কুমিল্লা। উক্ত বিষয়ে গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আসামীদেরকে কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
পৃথক আরেকটি আভিযানিক দল গোয়েন্দা তথ্য হতে প্রাপ্ত তথ্য ও তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে ২৫ এপ্রিল ২০২২ইং তারিখ রাতে রাজধানী ঢাকার সায়েদাবাদ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে উক্ত মামলার এজাহার নামীয় প্রধান আসামী ঘাতক স্বামী মোঃ ইকবাল হোসেন(৩৮), পিতা-কাজী মোঃ আঃ হাকিম, সাং-অলিপুর (উত্তর কাছার), থানা-কোতয়ালী মডেল, জেলা-কুমিল্লাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে ইকবাল জানায়, গ্রেফতারকৃত ইকবাল পেশায় একজন অটো চালক হলেও অটো চালানোর আড়ালে সে অটোসহ বিভিন্ন গাড়ির বেটারী এবং গাড়ি চুরিসহ বিভিন্ন ধরণের চুরির কাজে সমপৃক্ত ছিল। তার নামে গাড়ি চুরির একাধিক মামলাসহ গাড়ির বেটারী চুরির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও সে একজন পেশাদার জুয়াড়ী, মুলত জুয়া খেলার টাকা যোগাতেই সে চুরিসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত হতো যার কারণে তার সাথে তার স্ত্রী ফারজানার প্রায়ই কথা কাটাকাটি ও মনোমালিন্য হতো। সে তার স্ত্রী ফারজানাকে নিয়ে কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী থানাধীন অলিপুর গ্রামে একটি ভাড়া বাসায় থাকতো। ঘটনার দুইমাস পূর্বে ইকবাল অবগত ছিল।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ইং তারিখে কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী থানায় তার নামে একটি চুরির মামলার ওয়ারেন্ট জারী হয়েছে, যার কারণে সে যে কোন সময় গ্রেফতার হতে পারে। সে গ্রেফতারের পরে জামীনে বের হওয়ার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে ৫ হাজার টাকা জমিয়ে স্ত্রী ফারজানাকে দেয় এবং বলে আমি গ্রেফতার হলে তুমি এই ৫ হাজার টাকার সাথে তোমার বাবার বাড়ী থেকে আরও কিছু টাকা নিয়ে আমাকে জামিনে বের করবা। তার কিছুদিন পরেই গত ১১ মার্চ ২০২২ইং তারিখ ইকবাল তার নামে থাকা চুরির মামলার ওয়ারেন্টে গ্রেফতার হয়ে জেলে যায়। এদিকে স্বামী জেলে থাকায় স্ত্রী ফারজানা ভাড়া বাসায় শিশু সন্তানকে নিয়ে কি করবে কোনকিছু ভেবে না পেয়ে ইকবালের রেখে যাওয়া ৫ হাজার টাকা দিয়ে ট্রাক ভাড়া করে ভাড়া বাসার সমস্ত মালামল নিয়ে বাপের বাড়িতে চলে যায় এবং বাপের বাড়ি থেকেই ইকবালকে দেখার জন্য জেলখানাতে যায়।
জেলখানাতে গিয়ে ফারজানা তার স্বামী ইকবালকে ভাড়া বাসা ছেড়ে তার বাপের বাড়িতে চলে যাওয়ার ঘটনাটি বলতেই ইকবাল স্ত্রী ফারজানার উপর চড়াও হয় এবং তাকে দ্রুত ছাড়ানোর ব্যবস্থা করতে বলে। ফারজানা তাকে জেল হাযতে ভালোভাবে খাওয়ার জন্য এক হাজার টাকা দিয়ে দ্রুত ছাড়ানোর ব্যবস্থা করবে বলে আশ্বাস দিয়ে চলে আসে। ইকবালের স্ত্রী তাকে জামিনে বের করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও জামিনে বের করার ব্যাপারে কোন তৎপরতা প্রদর্শন না করায় তার স্ত্রীর প্রতি ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে তার অটোর মালিকের সহায়তায় এপ্রিল ২০২২ইং মাসের প্রথম সপ্তাহে জেল থেকে জামিন পেয়ে তার বোন কলির কাছে যায় এবং বোনের কাছে রেখে যাওয়া মোবাইল ফোন নিয়ে শশুর বাড়িতে যায়। শশুর বাড়িতে যাওয়ার পরে স্ত্রী কেন তাকে জামিন না করিয়ে বাসার মালামাল নিয়ে শশুর বাড়িতে চলে আসছে সেই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ফারজানা তার মতো জুয়াড়ী ও চোরের সাথে সংসার করবেনা মর্মে তাকে ডিবোর্স দেয়ার কথা বলে।
এই নিয়ে ইকবালের সাথে কথা কাটাকাটি ও বাকবিতন্ডা শুরু হয়। ঝগড়ার জেরধরে ইকবাল শশুরবাড়ি থেকে চলে আসে এবং প্রতিজ্ঞা করে তার স্ত্রী যেহেতু তার সাথে থাকবেনা সেহেতু সে তাকে দুনিয়াতেই রাখবেনা। এরই মধ্যে সে চিন্তা করতে থাকে ফারজানা যদি তার বাপের বাড়িতে থাকে তাহলে ইকবাল তার স্ত্রীকে হত্যা করতে পারবেনা তাই ইকবাল ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে ফারজানার কাছে নিজের ভূল স্বীকার করে ক্ষমা চায় এবং তাকে বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট করতে থাকে।
ঘটনার দিন ২৩ এপ্রিল ২০২২ইং তারিখ সে তার স্ত্রী ফারজানাকে ফোন করে বলে সে জেলে যাওয়ার পূর্বে তার বোন কলির কাছে তিন হাজার টাকা রেখে গিয়েছিলো যা কলি তাকে দিবেনা কেননা ইকবালকে টাকা দিলে সে জুয়া খেলে টাকাগুলো নষ্ট করে ফেলবে বিধায় এই টাকা তার স্ত্রী ফারজানার নিকট দিবে। ইকবাল ঐ টাকা নিয়ে তার একমাত্র শিশু সন্তানফারহানা আক্তার ইভা(০৭)‘কে ঈদের শপিং করে দিবে বল্লে ফারজানা আসতে রাজি হয়। পরবর্তীতে ইকবাল ফারজানাকে আনতে শশুর বাড়ি আলেখারচরে যায় এবং ফারজানাকে নিয়ে শশুর বাড়ি থেকে আনার সময় নিয়মিত যাতায়তের রাস্তা ব্যবহার না করে ইকবাল পূর্ব পরিকল্পিত জনশূন্য অপর রাস্তা দিয়ে নিয়ে আসতে থাকে।
পরিকল্পনা মোতাবেক ইকবালের পূর্ব পরিকলপিত স্থান যেখানে ফারজানাকে হত্যা করার জন্য পূর্বেই ইকবাল ইট রেখে গিয়েছিলো সেই স্থানে আসা মাত্রই রাত আনুমানিক ২১:৩০ ঘটিকার সময় ইকবাল তাকে পিছন থেকে ইট দিয়ে মাথায় সজোরেআঘাত করে। ইকবালের ইটের আঘাতে ফারজানা মাটিতে পড়েযায় এবং কান্নাকাটি শুরু করলে সে ফারজানার ব্যবহৃত ওড়না দিয়ে মুখ বেধে ফেলে এবং ইকবালের কাছে থাকা গামছা দিয়ে তার হাত বেধে ফেলে। এরপর একই ইট দিয়ে মাথায় একাধিকবার আঘাত করে। ইকবাল যখন স্থান ত্যাগ করে তখনও তার স্ত্রী জীবিত ছিল তবে রক্তক্ষরণ দেখে ইকবাল নিশ্চিত ছিল তার স্ত্রী খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মারা যাবে তাই লোকজন চলে আসার ভয়ে সে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।পরবর্তীতে ২৪ এপ্রিল ২০২২ইং তারিখ সকালবেলা হত্যার বিষয়টি জানাজানি হলে ইকবাল রাজধানী ঢাকায় আত্মগোপনে চলে যায়।
উক্ত বিষয়ে গ্রেফতারকৃত আসামী বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাকে কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী মডেল থানায় হস্তান্তর প্রক্রিয়াধীন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ আমার অহংকার এই স্লোগান নিয়ে র্যাব প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, জঙ্গি দমন, অবৈধ অস্ত্র, মাদক উদ্ধার, চাঞ্চল্যকর হত্যা এবং বিভিন্ন আলোচিত অপরাধীদের গ্রেফতারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। গোয়েন্দা নজরদারী ও আভিযানিক কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় অপরাধীদের দ্রুততম সময়ে গ্রেফতারের মাধ্যমে র্যাব ইতোমধ্যেই জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
মন্তব্য করুন